রাজনীতি: জটিল ধাঁধা, নাকি জীবনের চালিকাশক্তি?

রাজনীতি কেবল ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, বরং এটি সমাজ ও অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্নীতি, বিভাজন ও অসহিষ্ণুতা বড় চ্যালেঞ্জ হলেও তরুণদের আগ্রহ ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা জাগায়। সচেতন নাগরিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক ব্যবস্থাই দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির চাবিকাঠি।

রাজনীতি: জটিল ধাঁধা, নাকি জীবনের চালিকাশক্তি?
Image by : mfbtasarim from vecteezy

ঢাকা – সবজির বাজারে গিয়ে দাম শুনে ক্রেতাদের হতাশা নতুন নয়। চাল, ডাল থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, গ্যাস—দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি জিনিসের দামের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে অনেকেই আঙুল তোলেন রাজনীতির দিকে। কিন্তু রাজনীতি আসলে কী? কেন এর প্রভাব এত ব্যাপক? এই জটিল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে আজকের নিবন্ধ।

রাজনীতি, একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যা রাষ্ট্র, সরকার এবং সমাজের ক্ষমতা কাঠামোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সহজ ভাষায়, রাজনীতি হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সম্পদ ও ক্ষমতা বণ্টন করে। এই প্রক্রিয়া স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত বিস্তৃত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতি কেবল নির্বাচন বা সরকার গঠন নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকে। অধ্যাপক ড. রওনক জাহান, একজন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বলেন, "রাজনীতি হলো ক্ষমতার খেলা। কে, কখন, কীভাবে ক্ষমতা লাভ করবে এবং তা ব্যবহার করবে, সেটাই রাজনীতির মূল বিষয়।"

রাজনীতির জটিলতা বহুবিধ। এর মূলে রয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ এবং দৃষ্টিভঙ্গি। একটি সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও মতাদর্শের মানুষ থাকে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব চাহিদা ও প্রত্যাশা থাকে। এই চাহিদা ও প্রত্যাশাগুলো যখন পরস্পরবিরোধী হয়, তখন রাজনৈতিক সংঘাতের সৃষ্টি হয়।

উদাহরণস্বরূপ, শিল্পপতিরা চান করের হার কম থাকুক, যাতে তাদের ব্যবসায়ে সুবিধা হয়। অন্যদিকে, শ্রমিকরা চান ন্যায্য মজুরি এবং কর্মপরিবেশ। সরকার উভয়পক্ষের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু এই ভারসাম্য রক্ষা করা সবসময় সহজ নয়।

রাজনীতির জটিলতার আরেকটি কারণ হলো তথ্যের অভাব এবং ভুল তথ্য। অনেক সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতারা জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য মিথ্যা তথ্য ছড়ান। এর ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়। সামাজিক মাধ্যম এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে ভুয়া খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণে এই সমস্যা আরও বেড়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনীতির জটিলতা কমাতে হলে নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। তাদের সঠিক তথ্য জানতে হবে এবং নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে হবে। একইসাথে, রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে।

রাজনীতি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তা আলোচনা করাও জরুরি। রাজনীতি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, অর্থনীতি—সবকিছুই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকার যদি শিক্ষাখাতে বেশি বরাদ্দ দেয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা ভালো মানের শিক্ষা পাবে। আবার সরকার যদি স্বাস্থ্যখাতে অবহেলা করে, তাহলে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে।

রাজনীতি একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে। অন্যদিকে, একটি অস্থিতিশীল ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি দেশকে পিছিয়ে দিতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষভাবে জটিল। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে এদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের মেরুকরণ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং অসহিষ্ণুতা প্রায়শই সহিংস রূপ নেয়।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, "বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।"

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতি উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে এবং জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়ায়। দুর্নীতি কমাতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে, যা একটি ইতিবাচক দিক। তরুণরা এখন সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিষয়ে নিজেদের মতামত প্রকাশ করছে। তারা দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে।

তবে, তরুণদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু বাধা রয়েছে। অনেক তরুণ মনে করে যে রাজনীতি একটি নোংরা খেলা এবং এখানে সৎভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এই ধারণা পরিবর্তন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে তরুণদের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

রাজনীতিকে জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হলে নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। নিয়মিত ভোট দেওয়া, রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করা এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ করা—এগুলো নাগরিক দায়িত্বের অংশ।

রাজনীতি একটি জটিল ধাঁধা হতে পারে, কিন্তু এটি আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর ভালো-মন্দ দিকগুলো সম্পর্কে জেনে, সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমেই আমরা একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে পারি। রাজনীতিকে ভয় না পেয়ে, একে ইতিবাচক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

পরিশেষে, রাজনীতি কেবল ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, এটি একটি সমাজকে উন্নত করার মাধ্যম। প্রয়োজন শুধু সৎ উদ্দেশ্য, স্বচ্ছতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। তাহলেই রাজনীতি হয়ে উঠবে জীবনের চালিকাশক্তি।